BCS লিখিত প্রস্তুতি :: বাংলাদেশ বিষয়াবলি + বাংলা ২য় পত্র
বাংলাদেশ বিষয়াবলি :: Economy, Poverty Alleviation.
বাংলা ২য় পত্র :: রচনা (৪০ নম্বর) – ৩৪ তম বিসিএস
✎✎ মেড ইন বাংলাদেশ: অর্থনীতির প্রাণ পোশাকশিল্প ✎✎
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এই একটি স্লোগান সামনে রেখে সারা দেশে পোশাকশিল্পের এত উদ্যোক্তা, শ্রমজীবী মানুষ, শত শত কারখানা-প্রতিষ্ঠান, ৩৩ বছরের পরিশ্রমের পথপরিক্রমা। এত এত সফল উদ্যোক্তা আর সাফল্যের ইতিহাস বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে শিল্পসংশ্লিষ্ট কিছু দুর্ঘটনা আর সংকটের ঘেরাটোপে। নিরন্তর যেন এই পথচলা। শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্বাস, একটি সময় স্বস্তির বাতাস বইবেই। কিন্তু কেন যেন অস্থিরতার ঝড় থামছেই না।
.
১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা খাতটিতে ৪০ লাখ শ্রমিকের সিংহভাগ গ্রামীণ নারী। বর্তমানে বিজিএমইএর সদস্য কারখানা চার হাজার ৮৮২টি। এর মধ্যে দুই হাজার ৯২টি কারখানা সরাসরি রপ্তানি করে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির কারখানা দুই হাজার ৭৯০টি, যার মধ্যে কিছু বন্ধ বা অচল আর কিছুর অস্তিত্বই নেই। বিকেএমইএর সদস্য কারখানা এক হাজার ৮৭০টির মধ্যে সরাসরি রপ্তানি করে ৯০০টি। বাকি অর্ধেকের অবস্থা বন্ধ, অচল বা অস্তিত্বহীন। বন্ধ ও অস্তিত্বহীন কারখানাগুলো মূলত দেশের রাজনৈতিক কোলাহলের নিষ্ঠুর শিকার।
.
শুধু ৪০ লাখ শ্রমিক, পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা বা ২০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি দিয়ে পোশাকশিল্পকে বোঝা যায় না, মূল্যায়ন তো নয়ই। এই খাতকে বুঝতে হলে এর শিকড় অর্থনীতির কত গভীরে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। জাতীয় অর্থনীতিতে (জিডিপি) এ খাতের সরাসরি অবদান ১০-১১ শতাংশ। সম্পূরক অন্য শিল্প মিলে ১৪-১৫ শতাংশের কম নয়। পোশাক খাতে রপ্তানি হয় আনুমানিক এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। আমদানি হয় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যবর্তী পণ্য। নিট পোশাকে মূল্য সংযোজন প্রায় ৯০ শতাংশ আর ওভেনে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।
.
২.৭:১ শ্রমিক মেশিন অনুপাতে (৪৫ মেশিনে লাইন ভিত্তিতে) দেশে প্রায় ৩২ হাজার লাইন পোশাক কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বিনিয়োগ হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। কারখানায় একজন শ্রমিকের কাজের জন্য গড়ে আদর্শ জায়গা প্রয়োজন সর্বোচ্চ ৫০ বর্গফুট। কারখানাগুলো যদি শ্রমিকপ্রতি ৩৫ বর্গফুট করেও জায়গা দেয়, তাহলে শুধু কারখানা গড়তে হয়েছে ১৪ কোটি বর্গফুট। প্রতি বর্গফুট জায়গা গড়তে গড়ে এক হাজার টাকা ব্যয় হলেও, শুধু কারখানা নির্মাণ খাতে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর প্রতি বর্গফুটের ভাড়া গড়ে সাত টাকা ধরা হলে প্রতি মাসে জায়গার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৯৮ কোটি টাকা।
.
বিভিন্ন খাতে এ শিল্পের প্রভাবের আরেকটু গভীরে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতিদিন সাত হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার পোশাকশিল্পের পণ্য পরিবহনে নিযুক্ত। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৩ জেটির আটটি পোশাক খাতের পণ্য ওঠা-নামায় ব্যস্ত থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১২ সালে মোট কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়েছে এক হাজার ২০৫টি। এর মধ্যে পোশাকশিল্পের জন্য ব্যবহূত হয়েছে ৮৪৫টি। আর ১৩ লাখ ৪৩ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ২০০০-০১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় ছিল ৪৭৭ কোটি টাকা। ২০১১-১২ সালে সেই আয় এক হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। এর প্রধান অংশ এ শিল্পের বদৌলতে। যদি একজন শ্রমিক মাসে গড়ে ওভারটাইমসহ (ওভেন, নিট, সোয়েটার) ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন, তাহলে উদ্যোক্তাদের বেতন গুনতে হয় মাসে দুই হাজার কোটি টাকা, বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা। পোশাকশিল্পকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ছোট-বড় কারখানা। যেমন কম মূল্যের কসমেটিকস, জামাকাপড়, লুঙ্গি, টয়লেট্রিজ, স্যান্ডেল, ফিতা-চুড়ি, লিপস্টিক, টিফিন ক্যারিয়ার, ছাতা, নারকেল তেল, আয়না, হোটেল, দোকানপাট ইত্যাদি।
.
কারখানার শ্রমিক বোনেরা পায়ের স্যান্ডেল, লিপস্টিক, পাউডার, তেল, সাবান ইত্যাদিতে বছরে যদি মাত্র ৪০০ টাকা খরচ করেন, তাহলে বছরে ১৬০ কোটি টাকা এই খাতে যায়। ৩০ লাখ নারী শ্রমিক যদি বছরে ২৫০ টাকা করে চারটি শাড়ি বা কামিজ কেনেন, ঈদ-পার্বণ বা আত্মীয়স্বজনসহ, তাহলে বছরে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয় শুধু এই বাবদ। ১০ লাখ পুরুষ শ্রমিক যদি বছরে দুটি করে লুঙ্গি, শার্ট কেনেন, তাহলে বছরে ৭০ কোটি টাকা যায় এগুলো কিনতে। কত কারখানা গড়ে উঠেছে ছাতা-টিফিন ক্যারিয়ার বানাতে।
.
সম্পূরক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে টেক্সটাইল, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং, এমব্রয়ডারি, প্লাস্টিক, প্যাকেজিং, এক্সেসরিজসহ অনেক শিল্প। ১৯৮৫-৯০ সালে প্রায় হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা থেকে আজ স্থাপিত হয়েছে ৭১১টি টেক্সটাইল (৩০ হাজার ৭৫০ লুম), ৩৮৫টি স্পিনিং (৮৭ দশমিক ৮ লাখ স্পিন্ডেল), ২৩৩টি ডায়িং ফিনিশিং কারখানা। বিনিয়োগ হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। কারখানা গড়া হয়েছে পাঁচ কোটি ১০ লাখ বর্গফুটের মতো। নির্মাণ করতে লেগেছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এক্সেসরিজ শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা।
.
পোশাকশিল্পের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পোশাক টেক্সটাইল, উইভিং এক্সেসরিজ কারখানা স্থাপনে ঋণ নেওয়া হয় এক লাখ কোটি টাকার ওপর। ব্যাংক ইন্টারেস্ট ১২-১৮ শতাংশ, পাঁচ থেকে সাত বছর মেয়াদি। তারপর প্রতিদিনের আমদানি-রপ্তানি। শুধু পোশাক ও সহযোগী শিল্পের আমদানি-রপ্তানি বছরে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। এই টার্নওভারের ওপর নানা চার্জ, কমিশন আয় করে ব্যাংক-বিমা কোম্পানিগুলো। জোর দিয়ে বলতে পারি, দেশের বেশ কটি বড় ব্যাংক এবং বিমার অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে আছে পোশাকশিল্পের ওপর। পোশাকশিল্প সরাসরি অবদান রাখছে অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রে। দুই দিন হরতাল থাকলে হোটেলগুলোতে ক্রেতা বা অতিথির সংখ্যা অর্ধেকে দাঁড়িয়ে যায়। ছোট-বড় আরও অনেক খাত আছে, যা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
.
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্যবিমোচন এই দুটি সূচকে পোশাক খাতের অবদান গবেষণার দাবি রাখে। গ্রামীণ নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্যবিমোচনকে সমানভাবে উতরাতে পেরেছে। পোশাক খাত না থাকলে জনসংখ্যা সবশেষ শুমারির তুলনায় কমপক্ষে আরও দুই কোটি বেশি থাকত বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন।
পোশাকশিল্প যেমন অর্থনীতির চেহারা বদলে দিয়েছে, তেমনি গড়ে তুলেছে একটি নতুন উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, যারা পোশাক দিয়ে শুরু করেছিল, এখন অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগ করছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পোশাক ও এর আনুষঙ্গিক শিল্প ছাড়া অন্য কোনো বৃহৎ খাত পরিপক্বতা পায়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা দুঃখজনক। পোশাকশিল্পের বদৌলতেই বিশ্ব আজ বাংলাদেশকে ‘নেক্সট চায়না’ বলে আখ্যা দিচ্ছে।
একই সঙ্গে এ-ও বলতে হবে যে এই ৪০ লাখ শ্রমিক ছাড়া আমাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকত না। তাঁদের ন্যূনতম বেতন বাড়ানো, নিরাপত্তা নিয়ে যেমনি অনেক কিছু করার আছে, তেমনি বেশি উৎপাদনের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। কম্বোডিয়ায় সর্বমোট ৩০৯টি পোশাক কারখানায় কর্মরত তিন লাখ ৩৫ হাজার ৪৩২ জন শ্রমিক ২০১১ সালে রপ্তানি করেছে ৪ দশমিক শূন্য ৪৭ বিলিয়ন ডলার, যাতে করে মাথাপিছু শ্রমিকের রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭০ ডলারে। (উৎস: কম্বোডিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কেন লু, সেক্রেটারি জেনারেল, গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, কম্বোডিয়া) অন্যদিকে বাংলাদেশে ৪০ লাখ শ্রমিক রপ্তানি করে ২০ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা মাথাপিছু পাঁচ হাজার ডলার হয়। কম্বোডিয়ার শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ৭৪ ডলার। আমাদের শ্রমিক ন্যূনতম তিন হাজার টাকা হিসাবে মাসে পান চার হাজার ৫০০ টাকার কাছাকাছি। মোট শ্রমিকের শতকরা ১৫-১৮ ভাগ ন্যূনতম বেতনে চাকরি করেন। দুই দেশের উৎপাদন ক্ষমতায় আকাশ-পাতাল তফাত। এদিকটায় নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
.
তাজরীন ও সাভার দুর্ঘটনা সমগ্র পোশাকশিল্পকে বিশাল নাড়া দিয়েছে। সারা জাতি, বিশ্বের ক্রেতা-ভোক্তারা শঙ্কিত। এই দুর্ঘটনাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। অর্থনীতি ও সমাজজীবনের শিরা-উপশিরায় যে শিল্প বহমান, তাকে আরও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এর অতিক্রমে প্রয়োজন সবার সঙ্গে আন্তরিকভাবে কাজ করা।
.
★ নতুন বাজারে ভালো করছে বাংলাদেশ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রচলিত বা মূল বাজার। তবে পরিমাণে এখনো কম হলেও নতুন বাজারে ভালো করছে দেশের পোশাক খাত। গত তিন অর্থবছরে এই বাজারের রপ্তানি ২৩০ থেকে বেড়ে ৩৬১ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মোট পোশাক রপ্তানিতে নতুন বাজারের অংশীদার বেড়ে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
.
সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৪৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ইইউ এক হাজার ৪৭৪, যুক্তরাষ্ট্রে ৫১৪ ও কানাডায় ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি হয়। আলোচ্য সময়ে এসব দেশে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৭৫, ২ দশমিক ৮৪ ও ২ শতাংশ।
.
অন্যদিকে, একই সময়ে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার। এই আয় আগের ২০১২-১৩ অর্থবছরের ২৯৫ কোটি ডলারের চেয়ে ২২ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। তার মানে প্রচলিত বাজারের চেয়ে নতুন বাজারে প্রবৃদ্ধি বেশি। আর এই নতুন বাজারের মধ্যে তুরস্ক, জাপান, চীন, রাশিয়া, ভারতে ভালো করছে বাংলাদেশ। প্রতিবছরই রপ্তানি বাড়ছে। এমন তথ্যই দিচ্ছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান।
.
পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, আগামী দিনে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বাড়ানো কিছুটা কঠিন। কারণ এসব দেশে অনেক প্রতিযোগী। দিন দিন সেটি আরও বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পোশাক রপ্তানি কমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক। যদিও রানা প্লাজা ধস ও গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতাই আমেরিকার বাজার নিম্নমুখী হওয়ার বড় কারণ। শিগগিরই এই বাজারে রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। তবে একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হলে নতুন বাজারই বড় ভরসা। এ জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি-সুবিধা চুক্তি, অন্যান্য অশুল্ক বাধা দূর, নীতি-সহায়তা ও মেলা আয়োজন করতে হবে সরকারকে।
এদিকে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে সরকার ইতিমধ্যে কিছু কাজ করেছে। কানাডা, জাপান, চীন ও ভারত সরকারের সঙ্গে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি চুক্তি করেছে। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে নতুন বাজারে ৩ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অন্যান্য দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি চুক্তির চেষ্টা চলছে বলেও সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
.
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তুরস্কে গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা তার আগের অর্থবছরের ৪২ কোটি ডলারের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি। দেশটিতে তিন অর্থবছরের ব্যবধানে তুরস্কে ২৬ কোটি ডলার রপ্তানি বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে জাপানে ২০১১-১২ থেকে ২০১৩-১৪, তিন অর্থবছরে রপ্তানি হয় যথাক্রমে ৪০, ৪৭ ও ৫৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চীনে ২৪, রাশিয়ায় ২০, ব্রাজিলে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়ায় সাড়ে ১৩ কোটি, ভারতে নয় কোটি ও দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌনে পাঁচ কোটি ডলার আয় হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে চীনে। ৪২ শতাংশ।
.
পোশাকশিল্পের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা জানান, প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও নতুন বাজারে রপ্তানির পরিমাণ এখনো কম। তবে এই বাজারে রপ্তানি আরও বাড়ানোর অনেক সুযোগ আছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক, ব্যাংকিং ও কাস্টমসের কিছু জটিলতা আছে অনেক দেশে। যেমন রাশিয়ায় এখন মাত্র ২০ কোটি ডলার রপ্তানি হলেও সেখানকার বাজার প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের। দেশটিতে ৪২ শতাংশ শুল্ক ও কর দিয়ে রপ্তানি করতে হয়। অন্যদিকে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় যথাক্রমে ৩৫ ও ৪৫ শতাংশ শুল্ক ও কর দিতে হয়।
.
জানতে চাইলে বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় বাজারে শুল্ক হ্রাসে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। এগুলো করা গেলে আগামী ১০ বছরে পোশাকের মোট রপ্তানিতে নতুন বাজারের হিস্যা হবে ৬০-৭০ শতাংশ।
.
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, একক দেশ হিসেবে আমেরিকায় আমাদের রপ্তানি সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা ৩১ কোটি। আর চীনের জনসংখ্যা ১৩৬ কোটি। তার মানে চীনের বাজার বড়। সে দেশের ব্যবসায়ীরাও পোশাক ব্যবসা থেকে সরে আসছে। এই বাজারটি দখল করার সুযোগ আছে বাংলাদেশের। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের দিকেই আমাদের তাকিয়ে থাকলে হবে না।
.
★ স্বপ্নের পথনকশার বাস্তবায়ন অজানা!
(৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির চ্যালেঞ্জ)
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে শেষ করার কথা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত অর্ধেক কাজ হয়েছে। এ জন্য দেশের রপ্তানিকারকদের পণ্য পরিবহনে কয়েক গুণ বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে। নানা ধরনের জটিলতায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ধীরগতির জন্য এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট। আর এমন প্রেক্ষাপটেই পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি হবে ৫০ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি ডলার। স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশবাসীকে এই উপহার দিতে চায় বিজিএমইএ। এই স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছার পথনকশা খুঁজতে গত সপ্তাহে সাড়ে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে সংগঠনটি।
.
দেশের পোশাক রপ্তানির আয় গত অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ৪৪৯ কোটি ডলার। ৫০ বিলিয়নে পৌঁছাতে হলে এটি দ্বিগুণ করতে হবে। হাতে সময় মাত্র ছয় বছর। বিজিএমইএর নেতাদের ভাষ্য, বর্তমান বিশ্বে পোশাকশিল্পের বাজার ৪৫ হাজার কোটি ডলারের। এখানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৫ শতাংশ। আর মাত্র ৩ শতাংশ বাড়াতে পারলেই লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো যাবে।
.
অবশ্য এই রপ্তানি আয়ে পৌঁছাতে বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অ্যাপারেল সামিটের আলোচনা-বিতর্কে এ বিষয়গুলো ভালোভাবেই উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও সমান হারে বাড়বে। তখন চার লেন বদলে আট লেনের মহাসড়কের প্রয়োজন পড়েব। সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বর্তমানের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এ ক্ষেত্রে ভালো সমাধান। গ্যাস ও বিদ্যুতের প্রাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। তবে উদ্যোক্তারা এখনই চাহিদামতো গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে অনেক কারখানা সংস্কার ও স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু কারখানার মালিকেরা স্বল্প সুদে ঋণ পাচ্ছেন না। কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করতে আগামী পাঁচ বছরে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার লাগবে।
.
সামিটে অংশ নেওয়া দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও শিল্পের উদ্যোক্তারা ছয় বছরে পোশাক খাতের রপ্তানি ৫০ বিলিয়নে নিয়ে যেতে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি জোর দিয়েছেন কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নতিসহ শ্রমিকদের জীবনমান ও অধিকার নিশ্চিত করতে উদ্যোক্তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের ওপর। বলেছেন, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পণ্যের মানোন্নয়ন, উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরিতে মনোযোগ বাড়ানো দরকার।
..
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নের বিরাট কাজটি সরকারকে করতে হবে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে হবে। কারণ, সময়মতো কাজ শেষ না হলে উল্টো সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ছয় ঘণ্টায় যাওয়া যেত, এখন লাগে ১৬ ঘণ্টা।’
..
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা একটা পথনকশা তৈরি করতে চেয়েছি। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা সফল। এবার পুরো পরিকল্পনাটি গুছিয়ে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেব। একই সঙ্গে সরকারকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাব।’ তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বাড়ানোর জন্য এটি চাইছেন এমনটা ভাবলে ভুল হবে। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
..
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের বড় লক্ষ্য অর্জনে একটি কৌশল দরকার। শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিজিএমইএর উচিত একটি প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পণ্য কাঠামোর পরিবর্তন, মজুরি বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে সেই তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নিতে হবে। তারপর পরিকল্পনাটি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা দর-কষাকষিতে যাওয়া উচিত।’
..
সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, পরিকল্পনা পাওয়ার পর সরকারের উচিত পোশাকশিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে কীভাবে এটি গ্রহণ করবে সেটি নির্ধারণ করা। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতিশীল অন্যান্য রপ্তানি খাত যাতে চাপে না পড়ে, সেদিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে। সব মিলিয়ে একটি সামগ্রিক শিল্পায়ন পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে। তারপর সব পক্ষকে নিয়ে বাস্তবায়নে নামতে হবে।
..
● অবকাঠামো :
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক
গ্যাস ও বিদ্যুতের পর্যাপ্ততা
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ
.
● কর্মপরিবেশের উন্নতি :
উদ্যোক্তাদের মানসিকতা পরিবর্তন
শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ
সরকাির নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি
.
● অর্থায়ন :
কারখানা সংস্কার ও স্থানান্তর এবং নতুন কারখানা স্থাপনে স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা
.
● অন্যান্য :
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
কারখানার জন্য জমি
নতুন বাজার খোঁজা
বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন
গবেষণা
–
Samad Azad
–
উত্স ও তথ্যসূত্র :
পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।